চেঙ্গিস খানঃ ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়ংকর নারী লোভী শাসকের গল্প।

৪ কোটি মানুষ হ'ত্যা ২০ হাজার নারীকে ধ'র্ষণ করেছিল যে চেঙ্গিস খান, জেনে নিন সেই ভয়ংকর নারী লোভী শাসকের গল্প।

চেঙ্গিস খান (Genghis Khan) এর পরিচয়

আজকের এই পোস্টে, আমরা আপনাদের এমন একজন ব্যাক্তির সাথে পরিচয় করিয়ে দেব। যিনি দুনিয়ার সব চাইতে বড় লুটেরা, বিজেতা, রক্ত পিপাসু। একই সাথে তিনি দুনিয়ার সর্বকালের সবচাইতে ভয়ংকর ও নিশৃংস শাসক ছিলেন। তার নাম হল চেঙ্গিস খান (Genghis Khan)। ইতিহাসে এক স্মরণীয় ব্যাক্তি তিনি। তাকে মঙ্গোলীয় জাতির জনক ও বলা হয়ে থাকে। সমগ্র মঙ্গোলীয় জাতিকে এক করেছিলেন তিনি। তিনি ইতিহাসের মহা আলোচিত এক ব্যাক্তি। কারো কাছে তিনি লুটতরাজ, খুনি কিংবা প্রতিশোধ পরায়ণ এক পাগল রাজা বলে পরিচিত। আবার কারো কারো কাছে তিনি রিতীমত এক নায়ক। তিনি তার সৎ ভাইকে হ’ত্যা করেছিলেন। এবং জ়েলে ও যান। জেল থেকে মুক্তি পেয়ে সেই বয়সে মায়ের কাছে থেকে প্রাপ্ত জ্ঞ্যান, নিজের পরিবারের হাল ধরা এবং পরবর্তীতে সেই অভিজ্ঞতায় তার জন্য হয় পাথেয়।

এই চেঙ্গিস খান তার শাসন আমলে ৪ কোটির ও বেশি নিরপরাধ মানুষকে হ’ত্যা করেছেন। সেই সাথে বিশ হাজার নারী ও শিশু মেয়েদেরকে নির্মম ভাবে ধ’র্ষণ করেন। কোন এলাকার কোন ব্যাক্তি বা মানুষ যদি তার বিরুদ্ধে দাড়াতো বা অবস্থান নিত তাহলে তার পরিনাম খুব খারাপ হত। তিনি সেই জনপদের সকল মানুষকে হ’ত্যা করে ফেলতেন।

১২২২ সালে আফগানিস্তানের হেরাতে চেঙ্গিস খান শুধু তীর, মুগুর আর খাটো তলোয়ার দ্বারা হ’ত্যা করেছিলেন প্রায় ১৬ লক্ষ মানুষ। সম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা কালে তার বাহিনীর হাতে খুন হয় প্রায় ৪০ লাখের ও বেশি মানুষ। পৃথিবীর প্রায় অর্ধেক ধন সম্পদে ঠাসা ও ভরপুর তার সমাধি ক্ষেত্র। যার ঠিকানা বা অবস্থান আজ ও খুজে পাওয়া যায় নি। শোনা যায় যে, যারা চেঙ্গিস খানের এই কবরের খোজ করার চেষ্টা করেছিল, তারা প্রত্যেকেই কোন না কোন অপঘাতে মৃত্যু বরণ করেছে। অনেকে আবার রাতে ঘুমের মাঝে খুবই ভয়ংকর স্বপ্ন দেখে থাকেন। হাজার হাজার মানুষের আত্মচিৎকারের শব্দ শুনতে পেত তারা। তো চলুন এখন মুল বিষয়ে ফিরে যাই।

চেঙ্গিস খান (Genghis Khan) এর ছোট বেলা

১১৬২ সালে মঙ্গোলিয়ান ওলান নদীর তীরে একটি ছোট্ট গ্রামে চেঙ্গিস খান (Genghis Khan) জন্ম গ্রহণ করেন। তাকে তেমুজিন নামেও ডাকা হত। কথিত আছে যে, এই তেমুজিন জন্মেছিলেন হাতের মুঠিতে রক্ত নিয়ে। যা মঙ্গোলিয়ার ঐতিহ্য ও প্রথা অনুসারে ভবিষ্যতে নেতা হবার লক্ষণ প্রকাশ করে। মাত্র ছয় বছর বয়স থেকেই চেঙ্গিস খান (Genghis Khan) তার নিজ গোত্রের সাথে শিকার করার অভিজানে যেতেন। আর বয়স যখন নয়, তখন তার বাবা বরট নামের অন্য এক গোত্রের মেয়ের সাথে তার বিয়ে ঠিক করে ফেলেন।

কিন্তু বেচারার বউকে বিয়ের পরেই অপহরণ করা হয়। মনের দুঃখে কষ্টে সেই নয় বছর বয়সি বাচ্চা হাতে অস্ত্র তুলে নেন। তখন চেঙ্গিস খান তার বাবার বন্ধু তাগরুল খানের সহায়তায় অপহরণ কারী গোত্রদের পরাজীত করেন। এবং তার স্ত্রীকে উদ্ধার করেন। কিন্তু এ ঘটনার পরেই, অন্য আর একটি শত্রু গোত্রের দ্বারা চেঙ্গিস খান এর বাবাকে বিষ প্রয়োগের দ্বারা  হ’ত্যা করা হয়। এবং পুরো পরিবারকে ঘর ছাড়া করা হয়। তার পর থেকেই তিনি যেমন রাজ্যের পর রাজ্য জয় করেছে,  তেমনি ত্রাসেরও সৃষ্টি করেছেন।

আফগানিস্তানের হেরাতে চেঙ্গিস খান

১২২২ সালে আফগানিস্তানের হেরাতে চেঙ্গিস খান শুধু মুগুর, তীর আর খাটো তলোয়ার দিয়ে প্রায় ১৬ লক্ষ মানুষকে হ’ত্যা করেছিলেন। তার সম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার সময়ে তার বাহিনীদের দ্বারা খুন হয় প্রায় ৪০ লক্ষের ও বেশি মানুষ। সেই সাথে হাজার হাজার নারী ও শিশু মেয়ে তার দ্বারা বর্বরতার শিকার হয়। তিনি যে রাজ্য জয় করতেন, সেই রাজ্যের পুরুষ নাগরিকদের তার দাস বানিয়ে রাখতেন। আর আটক করা সুন্দরি নারীদের রাখা হত, তার মনোবাসনা পুরণ করার জন্য। প্রতি রাতেই তিনি নতুন নতুন মেয়েদের ভোগ করতেন। যে মেয়ে তার মনোবাসনা পূরণে ব্যার্থ হত, তাকে জোর করে পাষবিক নির্যাতন চালানোর পর গলা টিপে হ’ত্যা করা হত।

রাজ্য জয় করার পদ্ধতি

চেঙ্গিস খানের রাজ্য জয় করার পদ্ধতি ছিল ভয়াবহ রকমের ও বিভৎস রকমের বর্বরতা। কোন শহর জয়ের আগে তিনি সেই শহরের বাসিন্দাদের নির্শত্য আত্মসমর্পনের  আদেশ দিতেন। আর কেউ যদি তা প্রত্যাখান করে, তাহলে ঐ মঙ্গোলীয় চেঙ্গিস খান হয়ে উঠতেন হিংস্র হায়নার চেয়েও অধিক ভয়ংকর। নগর বাসীর উপর চালানো হত অতর্কিত হামলা, নারী, পুরুষ ও শিশু কেউই ঐ মঙ্গল বাহীনির বর্বরতা থেকে বাচতে পারে নি। নারী ও শিশু কন্যারা কোথায় লুকিয়ে আছে তা জানতে পুরো গ্রামে আগুন লাগিয়ে দেয়া হত। আর আগুনের ভয়ে লুকিয়ে থাকা নারী ও শিশুরা এদিক সেদিক ছুটতে থাকে। এসময় চেঙ্গিস খানের সৈন্যরা তাদের তুলে নিয়ে যায়। মারোব, বেইজিং,  সমর্খনদের মত মধ্যযযুগের জনবহল শহর গুলো মঙ্গল বাহিনীর পাষবিকতায় একদম মাটির সাথে মিশে গিয়েছিল। বর্তমান মধ্য এশিয়ার দেশ উজবিকিস্তানে সেই হ’ত্যা যোজ্ঞ এতটাই ভয়ংকর ছিল যে,  মঙ্গল সেনারা গর্ভবতী নারীদের পেট কেটে গর্ভের সন্তান বের করে উল্লাস করেছে।

মঙ্গল বাহিনী যে সব এলাকায় হামলা চালাতো, সে সব এলাকা হয়ে পরত জন শুন্য। হাজার হাজার বর্গ মাইল জুরে বিস্তৃত সভ্যতা ভুতুড়ে ও মরুভুমি নগরীতে পরিনত হয়ে যেত। আজ ও সেন্ট্রাল এশিয়ার বেশ কিছু শহরের ধ্বংসাবশেষ টিকে আছে মঙ্গল বাহিনীর ভয়াবহতার সাক্ষী হিসেবে।

চীন আক্রমণ

চেঙ্গিসের চীন আক্রমণের সময় সে দেশের জনসংখ্যা ছিল প্রায় ১০ কোটির মত। কিন্তু মঙ্গলদের চীন অভীযান শেষে ১৩০০ সালের আদম শুমারিতে দেখা যায় যে, চীনের জন সংখ্যা ছিল মাত্র ছয় কোটি। বাকি চার কোটির একটি বড় অংশের প্রাণ গিয়েছিল চেঙ্গিস খান ও তার বাহিনীদের হাতে। চেঙ্গিস খানের প্রতিশোধের উদাহরণ দিতে গেলে বলতে হবে, পারস্যের খাওয়ারিজম সম্রাজ্যের শাসক মোহাম্মদ শাহ এর কথা। মোহাম্মদ শাহ ছিলেন তৎকালীন মুসলিম বিশ্বের একজন শক্তিসালী সুলতান। প্রথম দিকে চেঙ্গিস খানের সাথে তার বন্ধুত্ব থাকলেও পরবর্তীকালে উভয়ের মধ্যেই বিরোধ দেখা দেয়। একবার চেঙ্গিস খানের একটি বানিজ্য বহর খাওয়ারিজমের উপর দিয়ে যাওয়ার সময়, মোহাম্মদ শাহ এর সৈন্যরা বানিজ্য বহরের লোক জন কে হ’ত্যা করে।

এ ঘটনার বদলা নিতে চেঙ্গিস খান ১০ হাজার সৈন্য নিয়ে খাওয়ারিজম আক্রমণ করে। হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু ঘটিয়েও তিনি ক্ষান্ত হন নি। মোহাম্মদ শাহ কে  আটক করে তার কান, নাক ও রূপা গলিয়ে সিল করে দেয়। চেঙ্গিস খানের নাম শুনে হয়তো আপনাদের মনে হতে পারে যে, তিনি মুসলান তথা ইসলাম ধর্মের ছিলেন। কিন্তু আসলে তিনি মুসলিম ছিলেন না। তিমি শাম ধর্মের অনুসারী ছিলেন। বিপদে তিনি নিজে আকাশের পুজা করতেন। তবে চীনের সন্যাসীদের সঙ্গে তিনি পৃথিবীর প্রায় নানা রকমের মানুষ আর তাদের ধর্ম নিয়ে আলোচনা করতেন।

তার ভয়ানক মৃত্যু্র ঘটনা

চীন দেশে ১২২৭ সালে ঘোড়ার পিঠ থেকে পরে তিনি মারা যান। মৃত্যুর পর তার দেহ চীন থেকে মঙ্গোলীয়াতে আনা হয়। চেঙ্গিস খান তার জীবন দশায় অছিয়ত করে গিয়েছিল যে, কেউ যেন তার দাফনের জায়গা বা স্থান টি জানতে না পারে। তাই তার শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী তাকে সমাহিত করা হয় মঙ্গোলীয়ার কোন এক অজ্ঞ্যাত স্থানে। চেঙ্গিস খানের মর দেহ নিয়ে মঙ্গোলিয়ার রাস্তায় শোকাহত সেনারা যখন হাটতেছিল, তখন তারা পথের ধারে যাদের কে দেখতে পেয়েছিল তাদেরকেই হ’ত্যা করে ফেলেছিল। আর কবর খোড়ার কাজে নিয়োজিত ২৫০০ শ্রমিক দের হ’ত্যা করেছিল তার বাহিনীর অন্য একদল সৈন্য। সেই সৈন্য দেরকে পরবর্তীতে হ’ত্যা করে তার ঐ বাহিনীর আর ও এক দল সৈন্য।

একই ভাবে এই সৈন্য দেরকে পরবর্তীতে হ’ত্যা করে তার ঐ বাহীনির আর ও এক দল সৈন্য। যারা সমাধি স্থলে উপস্থিত ছিল না। কারণ তারা সমাধি স্থলের কোন প্রত্যাক্ষ দর্সী রাখতে চায় নি। এমন কি চেঙ্গিস খানের সমাধির সব চিহ্ন মুছে ফেলে ঐ সৈন্যরা। এজন্য তারা সমাধির উপর দিয়ে এক হাজার ঘোড়া চালিয়ে নিয়ে যায়। যাতে তার কবরের উচু নিচু অংশ এবং আশে পাশের সব জায়গা মিশে যায় ধুলোর সাথে। এবং সেখানে গাছ পালা লাগিয়ে গভির জঙ্গল তৈরি করে দেয়া হয়।

তার কবর পৃথিবীর অর্ধেক ধন সম্পদ এ ভরপুর একটি রত্ন ভান্ডার

বলা হয়ে থাকে যে, চেঙ্গিস খানের সমাধি টি পৃথিবীর সব চাইতে বড় অনাবিষ্কৃত এবং অখ্যাত সমাধি। যার ভেতরে রয়েছে প্রায় পৃথিবীর অর্ধেক ধন সম্পদ এ ভরপুর বা ঠাসা একটি রত্ন ভান্ডার। চেঙ্গিস খান তার সারা জীবনে যে পরিমান ধন সম্পদ আর রত্ন লুট করেছেন, তার পুরো টুকুই সমাধি ক্ষেত্রে চেঙ্গিস খানের সাথে রেখে দেয়া হয়েছে। জয় লাভ করার পর ৭৮ জন রাজার মুকুট সেখানে আছে বলে ধারনা করেন অনেকেই। মধ্য যুগের ধন সম্পদের সব চেয়ে বড় এই গুপ্ত ধনের সন্ধান আজ পর্যন্ত কেউ করতে পারে নি। গুপ্ত ধন ছোয়া তো দুরের কথা,  কেউ আই গুপ্ত ধনের অবস্থান সম্পর্কে জানতেও পারেনি। যুগে যুগে মানুষ মঙ্গোলীয় এই সম্রাটের সমাধি ক্ষেত্র খুজে বের করার চেষ্টা চালিয়ে গেছে। বছরের পর বছর নষ্ট করেছে এই সমাধি খোজার পিছনে। কিন্তু কেউ তার সমাধি স্থলে পৌছাতে পারে নি।

ধারণা করা হয় তার এই সমাধি কোন এক দুর্গম পাহাড়ের কাছে দেয়া হয়। সর্বশেষ যত দূর জানা যায়, ১৯৯০ সালে মঙ্গোলীয়ার রাজধানীতে অবস্থিত উলান বাটা স্টেট ইউনিভার্সিটির প্রত্ন তত্ব বিভাগের প্রধান ডক্টর দিমাজার আর ডেনে বাটারি একটি উদ্যোগ নেয়। জাপানের সাথে যৌথ ভাবে নেয়া এই উদ্যোগের নাম ছিল তিন নদী প্রকল্প। কিন্তু সেটি ও ব্যার্থ হয়ে যায়।

শোনা যায় যে, যারা তার সমাধি ক্ষেত্র খোজার চেষ্টা করেছে তারা প্রত্যেকেই কোন না কোন অপঘাতে মৃত্যুর শিকার হয়েছে। তাদের মধ্যে অনেকে আবার রাতে ঘুমের মধ্যে ভয়াবহ স্বপ্ন দেখেছেন। হাজার হাজার মানুষের আত্মচিৎকারের আওয়াজ শুনতে পেত তারা।

You might also like

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More