রহস্যময় ঘুমের গ্রামে কয়েকদিন পর্যন্ত ঘুমিয়ে কাটিয়ে দেয়

যেখানে মানুষ রহস্যময় ভাবে কয়েকদিন পর্যন্ত ঘুমিয়ে কাটিয়ে দেয়।

রহস্যময় ঘুমের গ্রামে কয়েকদিন পর্যন্ত ঘুমিয়ে কাটিয়ে দেয় সবাই। ২০১০ সালের গ্রীষ্মকাল। ভিক্টর কাজাচেঙ্কো উত্তর কাজাখাস্তানের মরু অঞ্চলের উপর দিয়ে মোটরসাইকেল চালিয়ে নিকটস্থ গ্রামের দিকে যাচ্ছিলেন। কিন্তু সে ওখানে পৌছাতে পারেনি। ভিক্টর কোন এক রহস্যময় কারণে, মোটরসাইকেল চালানো অবস্থায় ঘুমিয়ে পড়ে। চারদিন পর হাসপাতালে তার ঘুম ভাঙে। তার সাথে কী ঘটেছিল, এর কিছুই সে মনে করতে পারে না। এই অদ্ভুত ঘটনা কিন্তু শুধু মাত্র তার সাথেই ঘটেনি।

আজ আপনাদের এমনই এক গ্রামের কথা বলব। যেখানে মানুষ রহস্যময় ভাবে কয়েকদিন পর্যন্ত ঘুমিয়ে কাটিয়ে দেয়। বিস্তারিত জানতে সম্পূর্ণ পোস্ট টি পড়ুন।

কাজাখাস্তানের কালাচি গ্রাম। চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের মাথা ঘুরিয়ে দেয়া এক রহস্যময় এলাকা। এখানকার মানুষ জন কোন এক রহস্যময় কারণে, গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। এমনকি তারা টানা কয়েকদিন পর্যন্ত ঘুমিয়ে কাটিয়ে দেয়। এবং আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, ঘুম থেকে ওঠার পর তারা এ ব্যাপারে কিছুই মনে করতে পারে না।

কালাচি গ্রামে তাইশিয়া নামে এক নারী থাকেন। তিনি তিনবার এই রহস্যময় গভীর ঘুমে আক্রান্ত হয়েছেন।

সাল ২০১২

তাইশিয়া প্রতিদিনের মত সেদিনও অফিসের কাজে ব্যস্ত ছিল। হঠাৎ করে তার মাথার ভিতর কেমন জানি খালি খালি লাগতে থাকে। কোন মতে ঘরে ফিরেই সে গভীর ঘুমে লুটিয়ে পড়ে। কয়েকদিন পর তার ঘুম ভাঙ্গে। ঘুম থেকে উঠে দেখে সে হাসপাতালের বেডে শুয়ে রয়েছে।

২০১৪ সালের মার্চ মাস

তাইসিয়া একটি কনসার্টে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। হঠাৎ করে তার প্রচুর ঝিম পাওয়া শুরু করে। তার প্রচুর ঘুম পাওয়া শুরু হয়। সে তখন সোফার এক কোণে বসেই ঘুমিয়ে পরে। পাঁচ দিন পর তার ঘুম ভাঙ্গে। ঘুম ভাঙ্গার পর সে নিজেকে হাসপাতালের বেডে দেখতে পায়।

ফেব্রুয়ারি ২০১৫

তবে এবারের অভিজ্ঞতা অন্যবারের চেয়ে কিছু টা ভিন্ন রকমের। তাইশিয়ার পা গুলো প্যারালাইসিসের মত হয়ে গিয়েছিল। সে ঝিমাতে ঝিমাতে হাটছিল। আর অ্যানেস্থিসিয়া করা রোগীদের মত করে কথা বলতেছিল। এভাবে আধো ঘুমে, সে প্রায় তিন দিন পার করে দেয়। অদ্ভুত ব্যাপার হল, সুস্থ হবার পর সে ঘটনা গুলোর কিছুই মনে করতে পারছিল না।

এই রহস্যময় ঘুম ধীরে ধীরে পুরো গ্রামে ছড়িয়ে পরে। কিন্তু কেন এমন হচ্ছে, তা কেউ বুঝতে পারছিল না।

মাছ ধরতে গিয়ে রহস্যময় ঘুম

২০১৩ সালে তাইশিয়ার স্বামী মাছ ধরতে গিয়ে রহস্যময় ঘুমে গভীরভাবে আচ্ছন্ন হয়ে পরে। মাছ ধরার বড়শি হাতে নিয়েই সে ওখানেই ঘুমিয়ে পরে। পরবর্তীতে তার এক বন্ধু তাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। ঘুমের ঘোরে তিনি তাইশিয়ার সাথে আবোল তাবোল বকছিলেন। কিন্তু ঘুম থেকে ওঠার পর তার সেসব ঘটনার কিছুই মনে নেই।

তিন বছরের মধ্যে কালাচি গ্রামের প্রায় ১০০ জনের ও বেশি মানুষ, এই রহস্যময় ঘুমে আক্রান্ত হয়ে পরে।

এই রোগে আক্রান্ত হলে ঠিক কেমন অনুভুতি হতে পারে?

১। প্রথমে মাথার ভিতর টা খালি খালি লাগতে শুরু করবে।

২।পা দুটি প্যারালাইসিসের মত বা ভারি হয়ে আসে।

৩। আক্রান্ত হবার মিনিট খানিকের মধ্যেই আক্রান্ত ব্যাক্তি বা প্রাণী গভীর ঘুমে লুটিয়ে পরে। কিংবা হ্যালোসিনেশন হতে থাকে।

৪। এদের দেখলে মনে হবে যে, খুব মনযোগ দিয়ে তারা আপনার বা আমার কথা শুনতেছে। কিন্তু এই সময় চোখ খোলা কিংবা চোখ নাড়ানোর শক্তি টুকুও তাদের মধ্যে থাকে না। কিছুটা স্লিপ প্যারালাইসিসের মত।

প্রাণীরাও এই রহস্যময় ঘুম রোগে আক্রান্ত

এক রিপোর্টে বলা হয় যে, শুধু মাত্র মানুষ নয়, অন্যান্য প্রাণীরাও এই রহস্যময় ঘুম রোগে আক্রান্ত হয়ে পরেছে। মারকুইস নামে একটি বিড়াল হঠাৎ করে অতিরিক্ত ডাকাডাকি শুরু করে। সামনে থাকা দেয়াল, ফার্নিচার যা কিছু পাচ্ছিলো সব কিছুকে আক্রমণ করতে শুরু করে। তারপর গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে মানুষের মত নাক ডাকতে শুরু করে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে হিমশিম খাওয়া কাজাখাস্থানের প্রশাসন বাধ্য হয়ে কালাচি গ্রামের বাসিন্দাদের অন্য এলাকায় চলে যাবার ব্যাবস্থা করে দেয়।  প্রায় ৫৫ টির ও বেশি পরিবার গ্রাম ছেড়ে অন্য জায়গায় চলে যায়। তবে অনেকেই আবার গ্রাম ছেড়ে যেতে না মত পোষণ করে। তাদের বিশ্বাস যে, এই রোগ তাদের কোন ক্ষতিই করবে না।

গবেষণা

এবার ডাক্তার ও বিজ্ঞানীরা এই ব্যাপারটি নিয়ে বিস্তর গবেষণা শুরু করে দেয়। তারা মাটি, পানি, বাতাস, এমনকি রোগীদের রক্ত, নখ এবং চুল মিলিয়ে প্রায় সাত হাজারের মত পরিক্ষা-নিরীক্ষা সম্পন্ন করে। কিন্তু ফলাফল শুন্য। তারা গ্রামের সব ধরনের সংযোগ লাইনের দিকে মনোযোগ ও নজর দেয়। আন্ডারগ্রাউন্ড গ্যাসের লাইনের সংযোগ বন্ধ করে দেয়া হয়। এমনকি মোবাইলের নেটওয়ার্ক টাওয়ারের সংযোগ ও বন্ধ করে দেয়া হয়। পানির সাপ্লাই লাইনে গভীর ভাবে পর্যবেক্ষন করা হয়। কিন্তু কোন যোগ সুত্র খুজে পাওয়া যায় না।

এর পর তারা গ্রাম থেকে প্রায় দুই মাইল দূরের এক ইউরেনিয়াম খনি নিয়ে পরীক্ষা-নিরিক্ষা শুরু করে দেয়। তাদের ধারনা ছিল যে, খনি থেকে রেডন গ্যাস বেরিয়ে এই সমস্যার সৃষ্টি করেছে। কিন্তু রেডিয়েশন এবং ইউরেনিয়াম লেভেল পরীক্ষা করে দেখা যায় যে, সব কিছু স্বাভাবিক পর্যায়ে রয়েছে। আর রেডিয়েশনের ফলে কখনো অতিরিক্ত ঘুম হয় না।

গ্রামের বাসিন্দার মতামত

তাহলে কেন হয় এই রহস্যময় ঘুম? আর একটি সুত্রে বলা হয় যে, গ্রামের বাসিন্দারা এই মরু গ্রামে থাকতে থাকতে বিরক্ত হয়ে গিয়েছিল। তারা তাদের এই কষ্ট থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য, নিজেরাই এই ঘুম রোগের উৎপত্তি ও প্রসার ঘটিয়ে তাদের অন্য জায়গায় নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রসাশনকে বাধ্য করে।

এই রহস্যময় ঘুম রোগ সারা বিশ্বে বিপুল সারা ফেলে দেয়। এমন সময় ইউরেনিয়াম খনির ডিরেক্টর ভিক্টর ক্রায়োকভ এক ভিন্ন সুত্র নিয়ে হাজির হন। তিনি দাবি করেন যে, এই ঘুম অসুখের প্রধান কারণ হল কার্বন মনো-অক্সাইড (Carbon Monoxide).। এর সাথে ইউরেনিয়ামের কোন সম্পর্ক না থাকলেও, ঐ ইউরেনিয়াম খনির সম্পর্ক রয়েছে। তার দাবি অনুযায়ী গবেষণা করতে গিয়ে দেখা যায় যে, ১৯৯০ সালে বন্ধ হয়ে যাওয়া ঐ খনির ভিতর পানি জমে গেছে। ফলে খুটির জন্য ব্যবহৃত কাঠ গুলো পঁচে গিয়েছে। ২০০১ ফুট গভীর এই খনিতে প্রায় ৬৩ অ্যাটোমোস্ফরিক চাপে পঁচা কাঠের সাথে রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে কার্বন মনো-অক্সাইড সৃষ্টি হয়। এবং ফাটল দিয়ে তা বাইরে বের হয়ে আসে। এই কার্বন মনো-অক্সাইড গ্যাস নিশ্বাসের সাথে গ্রহন করলে মানুষ গভীর ঘুমে তলিয়ে যায়। এবং এর মধ্যবর্তী কোন সৃতি তার মনে থাকে না।

ভুক্তভোগীরা হয়তো এই গ্যাস কোন ভাবে নিশ্বাসের মাধ্যমে গ্রহন করেছিল। তবে বিজ্ঞানীরা আর ও তথ্যের জন্য গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে।

You might also like

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More