লাল কেল্লার রোমহর্ষক রহস্য

লাল কেল্লার রহস্য

লাল কেল্লার (Lal Kila) নির্মাতা সম্রাট শাহ জাহান তার শেষ দিন টি কাটিয়েছিলেন গৃহ বন্দি হয়ে। তার ছেলে আওরঙ্গজেব তাকে বন্দি করে রেখেছিলেন এই কেল্লায় (Lal Kila)। এমন কি মুঘোল সম্রাজ্যের শেষ রাজা দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ এই লাল কেল্লাতেই (Lal Kila) বন্দি ছিলেন বৃটিশ দের হাতে। ভারতের আগ্রা থেকে লাল কেল্লায় (Lal Kila) চলে আসার পর থেকেই ভাঙ্গন ধরে মুঘোল সম্রাজ্যের। কেন এই বিখ্যাত লাল কেল্লা (Lal Kila) আজ ও অভিশপ্ত? ১০০ বছর আগে কেমন ছিল এই লাল কেল্লা (Lal Kila)। আজ এই লাল কেল্লার (Lal Kila) ব্যাপারে আপনাদের কিছু রোমহর্ষক ও রহস্য জনক তথ্য দেব।

কেন লাল কেল্লা বলা হয়

এই লাল কেল্লা (Lal Kila) আসলে দেখতে সাদা রঙ এর। হ্যাঁ, আপনি ঠিকই শুনছেন। সম্রাট শাহ জাহান ১৬৪৮ খ্রিস্টাব্দে লাল কেল্লা যখন তৈরি করেছিলেন, তখন এটি সম্পুর্ণ সাদা পাথর এ তৈরি করা হয়েছিল। যা দূর থেকে দেখতে ধুসর বা দুধ সাদা দেখা যেত। অনেকে এটাকে দেখে স্বর্গের কথা বলত। কিন্তু সময়ের ও কালের বিবর্তনের সাথে সাথে এই সাদা পাথর গুলো লালচে রঙ এর হয়ে যায়। তাই পরবর্তী কালে ব্রিটিশ সরকার এটাকে লাল রঙ করে দেয়। এবং তার পর থেকেই এটি লাল কেল্লা (Lal Kila) বা রেড ফর্ট (Read Fort) নামে পরিচিতি লাভ করে।

সম্রাট শাহ জাহান যখন এই লাল কেল্লা নির্মাণ করেন, তখন এটার নাম লাল কেল্লা (Lal Kila) ছিলো না। এর নাম ছিলো কেলায়ে মোবারাক। যার অর্থ হলো, আশির্বাদের দান। আগ্রার প্রচন্ড গরম সহ্য করতে পারতেন না সৌখিন সম্রাট শাহ জাহান। তাই তিনি তার রাজধানী আগ্রা থেকে দিল্লীতে পুনরায় স্থানান্তর করেন।

এর নির্মাণ করার কারণ

১৬৩৯ সালে এই কেল্লা নির্মানের কাজ শুরু হয়। প্রায় ২৫১ একর জমি জুড়ে গড়ে তোলা হয় এই লাল কেল্লা (Lal Kila)। তখনকার দিনে আধুনিক প্রযুক্তি না থাকায়,  এই কেল্লা নির্মাণের কাজ সম্পুর্ণ করতে প্রায় ১০ বছর সময় লেগে গেছিলো। এবং এই কাজে কারিগর হিসেবে নিয়োগ ছিলেন মুঘোল সম্রাজ্যের শ্রেষ্ঠ ২ নির্মাতা। এক জন হল ওস্তাদ হামিদ এবং আর এক জন হল ওস্তাদ আহমেদ। যাদের নিখুত কারিগরির নিদর্শন যুগ যুগ ধরে আজ পর্যন্ত আমাদের মনে জায়গা করে রয়েছে। বিশাল মুঘোল সম্রাজ্যের সম্রাট শাহ জাহান এর বাস স্থান সুরক্ষিত এবং শত্রু পক্ষের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য এই টি তৈরি করা হয়েছিল। যার কারনে এর দেয়াল ছিল প্রায় আকাশ ছোয়া উচু। সেই সাথে এটি প্রায় সম্পুর্ণ অভেদ্য। এই কেল্লার ভিতরে রয়েছে, প্রায় শতাধিক গুপ্ত দরজা। অনেকে আবার বলে থাকেন যে, এই লাল কেল্লার ভিতরে একটি গুপ্ত সুরঙ্গ রয়েছে। যার ব্যাবহার করে সোজা তাজ মহলে যাওয়ার ব্যাবস্থা রয়েছে।

তাজ মহল ও লাল কেল্লার সংযোগ

সম্রাট শাহ জাহান তার শেষ জীবনে বেশ কয়েক বার এই সুরঙ্গ ব্যাবহার করে তাজ মহলে গিয়ে মমতাজের সমাধির পাশে সময় কাটিয়েছিল। পরবর্তী কালে তার ছেলে আওরঙ্গজেব তাকে গৃহ বন্দি করে রাখলে, এই লাল কেল্লার (Lal Kila) যে ঘর থেকে তাজ মহল কে সরাসরি দেখা যায়, সেই ঘরে তাকে রাখার অনুরোধ করেন। কিন্তু ক্ষমতার লোভে অন্ধ সেই আওরঙ্গজেব এই অনুরোধ খারিজ করে দেয়। আপনি জানলে সব চেয়ে বেশিই অবাক হবেন যে, পৃথিবীর সব চাইতে দামী হীরে কোহিনুর (Kohinoor Diamond / Koh-i-Noor Diamond) এই লাল কেল্লার (Lal Kila) একটি অংশ। সম্রাট শাহ জাহান তার শাসন কালে এটিকে মুঘোল সম্রাজ্যের সম্পত্তি বানান। সোনার তৈরি ময়ুর সিংহাসনের চুড়ায় এই কোহিনুর হীরের ব্যাবহার করতেন সম্রাট।

পরবর্তী কালে দূর্ধষ লুটপাট কারী নাদির শাহ এই কোহিনুর হীরে (Kohinoor Diamond / Koh-i-Noor Diamond) ছিনিয়ে নেয় মুঘোল দের কাছ থেকে। সেখান থেকে হাত বদল হয়ে কোহিনুর হীরে গিয়ে পৌছায় ব্রিটিশ দের কাছে। বর্তমানে রাণী এলিজাবেথের রাজ মুকুটে এই হীরে ব্যাবহার করা হয়েছে।

লাল কেল্লার (Lal Kila) কারুকার্য এবং নকশার জন্য এটি আজ ও আমাদের মনে জয় করে রয়েছে। সম্রাট শাহ জাহান তার একান্ত আমোদ প্রমোদের জন্য এর ভিতরে একটি রঙ মহল নির্মাণ করে নিয়েছিলেন। এই রঙ মহলে শুধু মাত্র তার রাণীরা প্রবেশ করতে পারত। মাঝে মাঝে এখানে নাচ ও গানের আসর ও বসত। পরবর্তী কালে আওরঙ্গজেব সমস্ত নর্তকী দের সেখান থেকে তাড়িয়ে দেয়। মুঘোল সম্রাজ্যে ভারতবর্ষ ছিল অনেক বিশাল। বর্তমান কালের বাংলাদেশ ও পাকিস্তান ছিল ভারত বর্ষের এক অভিন্ন অংশ। লাল কেল্লার মুখ্য দরজা ছিল পাকিস্তানের দিকে। তাই এর নাম লাহোর গেট (Lahore Gate) রাখা হয়। বিশাল আকারের এই লাল কেল্লা মূলত অষ্টভুজ আকৃতির তৈরি।

ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হ্যারিটাইজ সাইটের অন্তর্ভুক্ত

আমরা যে সব বাড়ি বা স্থাপত্য দেখে থাকি, সেগুলোর বেশির ভাগই চার কোণা বা চতুর্ভুজ আকৃতির হয়ে থাকে। কিন্তু এই লাল কেল্লা সম্পুর্ণ ভাবে আট কোণা ধাচে তৈরি করা হয়েছে। যা একটি অকল্পনীয় নিদর্শন হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। এই লাল কেল্লা (Lal Kila) ভারতীয় ইতিহাস এবং সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হওয়ার ফলে, ২০০৭ সালে এটিকে ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হ্যারিটাইজ সাইট (UNESCO World Heritage Site) বলে ঘোষিত করা হয়।

আওরঙ্গজেবের হাতে সম্রাট শাহ জাহান বন্দি থাকা অবস্থায় এই লাল কেল্লা থেকে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তিনি ভাগ্য ক্রমে ধরা পরে যান শয়তান আওরঙ্গজেবের হাতে। এই ঘটনার পর আর ও কঠর নজর দারি রাখা হয়েছিল তার উপর। সম্রাট শাহ জাহান যে অভেদ্য লাল কেল্লা (Lal Kila) বানিয়েছিলেন শত্রু পক্ষের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য, সেই লাল কেল্লাতেই বন্দি হয়ে পরে ছিলেন তার নিজের ছেলের হাতে। সম্রাট শাহ জাহান তার জীবনের শেষ মুহুর্ত খুবই কষ্টে জীবন যাপন করেছিলেন। বিশাল ঐশর্য্যের মালিক হয়েও সম্রাট শাহ জাহান কে দিন কাটাতে হয়েছিল নিজের ছেলের হাতে গৃহ বন্দি হয়ে। মিতা প্রেয়সি মমতাজের সমাধি দেখার জন্য বন্দি দশায় সব সময় ছটফট করতেন শাহ জাহান। কিন্তু কোন উপায় ছিল না। তার মেয়ে জাহানারা লুকিয়ে লুকিয়ে তাকে ছাদে নিয়ে যেতেন দূর থেকে সেই তাজ মহল দেখানোর জন্য। হয়তোবা ধন সম্পত্তি ও ঐশর্য্যের দিকে মোহ মায়া্র কারণে নিজের সন্তান দের সঠিক শিক্ষা দিতে পারেন নি সম্রাট শাহ জাহান।

তার মৃত্যুর প্রায় একশ থেকে দেড়শ বছর পর  লাল কেল্লা (Lal Kila) ব্রিটিশ সরকারের দখলে চলে যায়। তারা সব খানে লুট পাট চালায়। সব রকমের দামি দামি আসবাব পত্র সহ সমস্ত মূল্যবান জিনিস ব্রিটিশরা বিদেশে পাঠিয়ে দেয়। লাল কেল্লাকে তারা শাসন ব্যাবস্থার প্রধান প্রাসাদ বানায়। তারপর ব্রিটিশরা ভারত ছাড়লে লাল কেল্লাকে ভারতের পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা হয়। প্রতি দিন প্রায় হাজার হাজার পর্যটক এই লাল কেল্লায় ঘুরতে আসেন। এছাড়াও প্রতি বছর ১৫-ই আগস্ট ভারতের স্বাধীনতা দিবসে প্রধান মন্ত্রী এখান থেকে পতাকা উত্তোলন করেন।

You might also like

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More