জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপের ক্ষমতা হ্যাবেলের থেকে কত বেশি?

জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপের ক্ষমতা হ্যাবেলের থেকে কত বেশি জেনে নিন

আকাশ ভরা সূর্য তারা বিশ্বভরা প্রাণ। কথাটা শুধুমাত্র বিজ্ঞানের নয়, সাধারণ মানুষেরও। আদিম কাল থেকেই মানুষ এই কথার ব্যাখ্যা খুঁজে আসছে। আদিম মানুষেরা রাতের অন্ধকার আকাশের দিকে তাকিয়ে বিস্ময়ের সাথে সাথে অবাকও হয়ে যেত । আর সেই একই বিস্ময়কে নিয়েই, এখনকার বিজ্ঞানীরাও মহাকাশের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। চেষ্টা করছে কোন এক জানার মাঝে অজানা বিষয় বস্তুর খোজ করতে।

টেলিস্কোপ

আমরা আমাদের এই ব্রমান্ডের সম্পর্কে যতটা আজ পর্যন্ত জানতে পেরেছি, তার মধ্যে সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেছে টেলিস্কোপ। আমাদের ইউনিভার্সকে জানার জন্য, যে দুইটি টেলিস্কোপ সব চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেছে, তার মধ্যে প্রথমটি হল হ্যাবেল টেলিস্কোপ (Hubble Telescope)। এবং দ্বিতীয়টি হল ক্যাপ্লার টেলিস্কোপ (Kepler Telescope).।

আমরা এই দুটি টেলিস্কোপের সাহায্যে ব্রমাণ্ডের লাখো আলোক বর্ষ দূরের এমন সব সৌরমন্ডলের খোজ পেয়েছি, যেগুলো আমাদের সৌরমন্ডলের মতই। এবং ঐ সমস্ত সৌরমন্ডল আমাদের পৃথিবীর মতই প্রাণের সম্ভাবনাতে ভরপুর। সত্যিকার অর্থ্যে, এই দুইটি টেলিস্কোপ মানব দ্বারা তৈরি করা একটি উত্তম ম্যাশিন।

আপনি যদি এই দুটি টেলিস্কোপ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চান, তাহলে কমেন্ট করে জানাবেন। পরবর্তীতে আমি এই বিষয়ে লিখব।

ক্যাপ্লার টেলিস্কোপ (Kepler Telescope)

ক্যাপ্লার টেলিস্কোপ (Kepler Telescope) এখন বর্তমানে অবসর হয়েছে বলা যায়। এই টেলিস্কোপ টি ৭ মার্চ ২০০৯ থেকে ১৫-ই নভেম্বার ২০১৫ পর্যন্ত নিরন্তন অজানাকে জানতে আমাদের বিজ্ঞানীদেরকে সাহায্য করে গেছে।

হ্যাবেল টেলিস্কোপ (Hubble Telescope)

অপর দিকে ১৯৯০ থেকে হ্যাবেল টেলিস্কোপ (Hubble Telescope) এখন ও পর্যন্ত বিজ্ঞানীদের হয়ে কাজ করে যাচ্ছে। এবং এই টেলিস্কোপ অনেক অজানা বিষয় বস্তুর সন্ধান ও উত্তর আমাদের দিয়েছে। যেমনঃ এই অব্জারভেবল ইউনিভার্সেল এর বয়স কত? আমাদের ইউনিভার্স শিশু বয়সে কেমন দেখতে ছিল? আমাদের সৌরমন্ডল কিভাবে তৈরি হল? এই মহাবিশ্বে আমাদের পৃথিবীর মতই কি অন্য গ্রহে প্রাণ হতে পারে?

এসব প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার পরও, আরও এমন অনেক প্রশ্ন আছে যার উত্তর এই টেলিস্কোপের সাহায্যে জানা সম্ভব নয়। যেমনঃ আমাদের এই ইউনিভার্সের প্রথম তারা বা গ্যালাক্সি কিভাবে তৈরি হল? এই ইউনিভার্স সৃষ্টি হওয়ার কয়েক মুহুর্ত পর কেমন দেখতে ছিল? শিশু ইউনিভার্সের তারা, গ্যালাক্সি বা গ্রহের সাথে এমন কি হয়েছিল যে, যার কারণে আমাদের এই ইউনিভার্স এমন হল? যেমন টা আজ আমরা দেখতে পারছি।

ডার্ক মেটার এবং ডার্ক এনার্জি কি? এবং এগুলোর তৈরি কি কারনে হয়েছিল? আর ধুলার বিশাল মেঘের মধ্যে তারার জন্ম কিভাবে হয়। এই সমস্ত প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার জন্য আমাদের হ্যাবেল টেলিস্কোপ (Hubble Telescope) এর থেকেও অধিক ক্ষমতা সম্পন্ন আর একটি টেলিস্কোপের প্রয়োজন হবে। এছাড়াও আমাদের নতুন একটি টেলিস্কোপের প্রয়োজন এর জন্য হবে যে, কারণ প্রতিটি বস্তুর একটি নির্দিষ্ট সময় সীমা থাকে। যে সময় এর পর ঐ বস্তু তার কর্ম ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। আর হ্যাবেল টেলিস্কোপ (Hubble Telescope) প্রায় ২৯ বছর ধরে বিশ্রাম ছাড়াই কাজ করে যাচ্ছে। তাই এই টেলিস্কোপ অল্প কিছু দিনের মধ্যে পরিত্যাক্ত বলে গন্য হবে।

জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ (James Web Space Telescope)

অপর দিকে ভালো খবর তো এটাই যে, নাসা, ই.এস.এ আর সি.এস.এ মিলে একটি অ্যাডভান্স টেলিস্কোপ তৈরি করে নিয়েছে। যেটা ৩০ মার্চ ২০২১ সালে লঞ্চ করা হবে। এই অ্যাডভান্স টেলিস্কোপটির নাম জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ (James Web Space Telescope)।

এখন আমরা এই টেলিস্কোপ সম্পর্কে বিস্তারিত জানব। সাথে আরও জানব যে, হ্যাবেল টেলিস্কোপের থেকে এই টেলিস্কোপ কতটা আলাদা।

গত ২৯ বছরে হ্যাবেল টেলিস্কোপ আমাদের আশার থেকেও অধিক নিপূন ভাবে কাজ করে গেছে। এর থেকে আমরা জানতে পেরেছি যে, আমাদের ইউনিভার্স ক্রমাগত শুধু বড়ই হচ্ছে না, এর বড় হওয়া বা ছড়িয়ে পরার গতি দিনে দিনে আরও বেড়েই চলেছে। এছাড়াও সুদূর ইউনিভার্সের যে সমস্ত ছবি আজ আমরা দেখছি, সেসব হ্যাবেল এর মাধ্যমেই করা হয়েছে। কিন্তু ইউনিভার্সের এমন অনেক এলাকা রয়েছে,  যে জায়গা গুলোতে হ্যাবেলের দৃষ্টি পৌছাতে পারে না।উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, যদি কোন গ্যালাক্সিতে পর্যাপ্ত পরিমানে ধুলার মেঘ সৃষ্টি হয়। তাহলে হ্যাবেল ধুলার মেঘের পিছনে থাকা তারা গুলোকে দেখতে পায় না। এরকম কিছু দূর্বলতা হ্যাবেল টেলিস্কোপের মধ্যে বিদ্যমান রয়েছে।

আর এই কারনেই জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ (James Web Space Telescope) কে তৈরি করা হয়েছে। এখন আমরা জানব যে, হ্যাবেলের থেকে কিভাবে এবং কি রকম আলাদা এই অ্যাডভান্সড টেলিস্কোপ।

বিস্তারিত

হ্যাবেল টেলিস্কোপের প্রাইমারি মিররের সাইজ ২.৪ মিটার। যেটা মোটেও কোন ছোট সাইজ নয়। কিন্তু জেমস ওয়েব স্পেসের প্রাইমারি এই মিররের সাইজ হল ৬.৫ মিটার। যা আকারে হ্যাবেলের থেকে প্রায় ৩ গুন বড়। এই বড় মিররের কারনে আমরা আমাদের ব্রমান্ডের প্রথম গ্যালাক্সি থেকে আসা আলোর কিরণকেও হ্যাবেলের তুলনায় জেমস অয়েব স্পেস টেলিস্কোপের সাহায্যে অনেকটাই পরিস্কার দেখতে সক্ষম হব। হ্যাবেলকে এমন ভাবে তৈরি করা হয়েছিল যেন নভোচারি হ্যাবেলের সময়ের সাথে সাথে খারাপ হয়ে যাওয়া ম্যাশিনকে পরিবর্তন করতে পারে। একই সাথে হ্যাবেলকে আরও অধিক অ্যাডভান্সড করতে পারে। এখন ও পর্যন্ত ৫ বার হ্যাবেলকে স্পেস এ গিয়ে মেরামত করা হয়েছে। এটার মিরর আর মেমরি সহকারে অনেক ম্যাশিনকে আপগ্রেড করা হয়েছে। যেন এটা সঠিক ভাবে আর ও অধিক সময় পর্যন্ত কাজ করতে পারে।

জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ এর কাজ কি?

অপর দিকে যদি কথা বলি জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপের, তাহলে বলতে হয় যে, এটাকে স্পেস এ মেরামত করার জন্য তৈরি করা হয়নি। এর মানে যদি এটাকে একবার স্পেসে লঞ্চ করা হয় তাহলে এরপর এটাকে রক্ষণাবেক্ষণ করার দায়িত্ব নিজেকেই নিতে হবে । এর কারণ হলো জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপকে আলাদা ধরনের লাইট কে ক্যাপচার করার জন্য তৈরি করা হয়েছে। যেখানে হ্যাবেল টেলিস্কোপ আলট্রা ভায়োলেট ভিজিবল তথা কিছু ইনফায়রেট লাইটকে ডিটেক্ট করার জন্য তৈরি করা হয়েছিল অপরদিকে জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপকে ইনফারেট লাইট ওয়েবকে ক্যাপচার করার জন্য তৈরি করা হয়েছে।

এর মানে হল এটি একটি ভীষন ঠাণ্ডা টেলিস্কোপ হবে। যেটা মাইনাস ২৩০ ডিগ্রি টেম্পারেচর এও কাজ করতে পারবে। এটা এই কারনে গরম অবজেক্ট হিট রেডিয়েশন অ্যামেট করে থাকে। যার কারনে, যদি ইনফায়রেট টেলিস্কোপ এর সেন্সিটিভি ভালো হোক এটা আশা করা হয়, তাহলে এটাকে ঠাণ্ডা অবশ্যই রাখতে হবে। তা না হলে তার নিজের হিট রেডিয়েশনের কারণে টেলিস্কোপের সামনে এতটাই আলো চলে আসবে যে, টেলিস্কোপ কিছুই দেখতে পারবে না।

জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপকে ঠান্ডা রাখার জন্য ক্রায়োজনিকের ব্যবহার করা হবে। জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ এর সাহায্যে আমরা আমাদের ইউনিভার্সের অতীতের ঐ সময় গুলোকে দেখতে পারব। যেটা আমরা আজ পর্যন্ত দেখতে পাই নি। আপনাদের মধ্যে অনেকেই হয়তো এটা ভাবছেন যে, আমরা কিভাবে আমাদের ইউনিভার্সের অতীতকে দেখতে পারব? যখন সব কিছুই প্রথম থেকে ঘটে গেছে। এই প্রশ্নের উত্তর হল যে, আমরা আলোর সাহায্যে তা দেখতে পারব।

আসুন এটাকে সহজ ভাবে বোঝার চেষ্টা করি।

মনে করি কোন একটি গ্যালাক্সির জন্ম আজ থেকে ১৩ বিলিয়ন বছর পূর্বে হয়েছে। আর ঐ গ্যালাক্সির আলো আমাদের এই ব্রমান্ডে তখন থেকে আজ পর্যন্ত ট্রাভেল করে যাচ্ছে। এখন যদি আমরা ঐ গালাক্সির আলোকে বর্তমানে আমরা আমদের পৃথিবী থেকে ক্যাচ করতে পারি, তাহলে আমরা মূলত ঐ গ্যালাক্সির ১৩ বিলিয়ন পূর্বের রূপকে দেখতে পারব। এটা ঠিক এমন যে, যদি পৃথিবী থেকে ২০০ মিলিয়ন লাইটস ইয়ার দূরে মজুদ অন্য কোন গ্রহ থেকে বর্তমানে কোন প্রাণী আমাদের এই পৃথিবীকে দেখে, তাহলে তারা আমাদের পৃথিবীতে হয়তো ডায়নোসরকে দেখতে পারবে।

আমরা জানি আমাদের এই ব্রম্মান্ডের প্রতিনিয়ত বিস্তার হচ্ছে। তথা গ্যালাক্সি একে অপরের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। যেভাবে দূরে সরে যাওয়ার সময় একটি ট্রেনের সাউন্ড ধীরে ধীরে কম হতে থাকে। ঠিক একই ভাবে। আমাদের থেকে দূরে সরে যাওয়ার সময় প্রাচীন গ্যালাক্সির আলোও আমাদের কাছে পৌছাতে পৌছাতে অনেকটাই ক্ষীণ হয়ে ইনফায়রেটে প্রবর্তিত হয়ে যায়। যার ফলে সেটাকে সাধারণ নিয়মে বা অবস্থায় দেখা যায় না। কিন্তু ইনফায়রেট ডিটেক্টর এটাকে অতি সহজে ডিটেক্ট করতে পারে। যেহেতু জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ ইনফায়রেট লাইটকে ক্যাপচার করতে সক্ষম  হবে, সেহেতু আমরা আমাদের ব্রম্মান্ডের প্রাচীণ তারা এবং গ্যালাক্সি দের দেখতে পারব। আশা করা হচ্ছে জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ দ্বারা আমরা হ্যাবেলের থেকেও ১০০ মিলিয়ন ইয়ারস পুর্বের ইউনিভার্সকে অতি সহজেই দেখতে পারব। যেহেতু জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপকে মুখ্য রূপে ঠাণ্ডা আবহাওয়ায় কাজ করার জন্য তৈরি করা হয়েছে। সেহেতু এটাকে হ্যাবেলের মত তৈরি করা হয়নি।

সান সিল্ড

এই টেলিস্কোপকে এর সাথে সান সিল্ড ও নিয়ে যেতে হবে। যার সাহায্যে সে সুর্যের তাপ থেকে নিজেকে রক্ষা করতে সক্ষম হবে। সান সিল্ড এ ৫টি লেয়ার হবে। এই সিল্ড না শুধু টেলিস্কোপকে ঠান্ডা রাখবে। বরং এটা টেলিস্কোপ কে স্পেস ডেপ্রেচ থেকেও রক্ষা করবে। জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ এবং তার সান সিল্ড এতটাই বিশাল হবে যে, এটাকে লঞ্চ করার পর এটাকে তার নিজের পার্টস এর অ্যাসেম্বিলিং নিজেকেই করতে হবে। হ্যাবেল এবং জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ এর মধ্যে একটি পার্থক্য হল পৃথিবী থেকে তাদের দুরুত্ব। হ্যাবেল পৃথিবীর সার্ফেস থেকে ৫০০ কিলোমিটার দূর দিয়ে প্রদক্ষিণ করছে। কিন্তু যেহেতু জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপকে অনেকটাই ঠান্ডা আবহাওয়ার মধ্যে রাখতে হবে, সেহেতু এটাকে পৃথিবীর কক্ষে স্থাপন করা হবে না। এটাকে পৃথিবী থেকেও ১.৫ মিলিয়ন কিলোমিটার দূরে স্থাপন করা হবে। যেন এটা নিজেকে অতি সহজেই ঠান্ডা রাখতে পারে।

জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ বর্তমান বিজ্ঞানের একটি উল্লেখ্যযোগ্য কৃতিত্ব হবে। আশা করা হচ্ছে জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ আর হ্যাবেল টেলিস্কোপ এক সাথে অল্প সময়ের জন্য হলেও কিছু দিন কাজ করতে পারবে। যা আমাদের বিজ্ঞানীদেরকে এই ব্রম্মান্ডের আরো কিছু অজানা রহস্যকে জানতে সাহায্য করবে।

You might also like

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More