সাবরিনা আরিফ চৌধুরী কে ৩ দিনের রিমান্ডে নেয় পুলিশ

সাবরিনা আরিফ চৌধুরী কে ৩ দিনের রিমান্ডে নেয় পুলিশ

রোববার জেকেজি (জোবেদা খাতুন হেলথ কেয়ার) এর চেয়ারম্যান সাবরিনা শারমিন হুসেইন ওরফে ডা. সাবরিনা আরিফ চৌধুরী কে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। আলোচিত জেকেজি হেলথ কেয়ারের চেয়ারম্যান চিকিৎসক সাবরিনা শারমিন হুসেইন ওরফে ডা. সাবরিনা আরিফ চৌধুরী কে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আদালত তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছে।

সোমবার দুপুরের দিকে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালত এই রিমান্ডের আদেশ দিয়েছে।

সিএমএম আদালত এর হাজতখানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এসআই শহীদুল ইসলাম জানান যে, সাবরিনা শারমিন হুসেইন ওরফে ডা. সাবরিনা আরিফ চৌধুরী কে পুলিশ আদালতের মধ্যে হাজির করে ৪ দিনের রিমান্ডের জন্য আবেদন জানায়। শুনানি শেষে আদালত সাবরিনা শারমিন হুসেইন ওরফে ডা. সাবরিনা আরিফ চৌধুরী কে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ৩ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে।

করোনা এর নমুনা পরীক্ষার জালিয়াতির অভিযোগের কারণে পুলিশ সাবরিনা শারমিন হুসেইন ওরফে ডা. সাবরিনা আরিফ চৌধুরী কে রোববার গ্রেপ্তার করে।

জেকেজি (জোবেদা খাতুন হেলথ কেয়ার)

জোবেদা খাতুন হেলথ কেয়ার, সংক্ষেপে জেকেজি এর কার্যক্রম ২০১৫ সালে শুরু হয়েছিলো। ঐ বছরেই সাবরিনা শারমিন হুসেইন ওরফে ডা. সাবরিনা আরিফ চৌধুরী কে বিয়ে করেন। বিয়ের পর ব্যবসায়ী আরিফুল হক চৌধুরী এই ‘অলাভজনক’ প্রতিষ্ঠানটি তাঁর দাদির নামে গড়ে তুলেছিলেন।

সাবরিনা শারমিন হুসেইন ওরফে ডা. সাবরিনা আরিফ চৌধুরী

জেকেজি (জোবেদা খাতুন হেলথ কেয়ার) ওভাল গ্রুপ লিমিটেডের একটি সহযোগী প্রতিষ্ঠান। এটি একটি ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট ফার্ম। প্রতিষ্ঠানের প্রধান আরিফুল হক চৌধুরী হওয়া সত্ত্বেও চেয়ারম্যান হিসেবে পরিচয় দিতেন সাবরিনা শারমিন হুসেইন ওরফে ডা. সাবরিনা আরিফ চৌধুরী। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন রকমের গুরুত্বপূর্ণ দিবসের কাজ পেয়ে আসছিল ওভাল। এমনকি ঢাকা এক্সপোর আয়োজন উপলক্ষে গত অক্টোবর মাসে সংবাদ সম্মেলনেও ওভালের চেয়ারম্যান হিসেবে বক্তব্য দিয়েছেন সাবরিনা শারমিন হুসেইন ওরফে ডা. সাবরিনা আরিফ চৌধুরী।

জুন মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত দুজন মিলেই জেকেজি (জোবেদা খাতুন হেলথ কেয়ার) চালাচ্ছিলেন। কিন্তু দাম্পত্য কলহের জেরে সাবরিনা শারমিন হুসেইন ওরফে ডা. সাবরিনা আরিফ চৌধুরী জেকেজি (জোবেদা খাতুন হেলথ কেয়ার) থেকে সরে আসেন। ঐ মাসের তৃতীয় সপ্তাহে পুলিশ জেকেজি (জোবেদা খাতুন হেলথ কেয়ার) তে অভিযান চালায়।

পুলিশ জানতে পারে, জেকেজি (জোবেদা খাতুন হেলথ কেয়ার) বিনা মূল্যে পরীক্ষার অনুমতি নিয়েছিল। কিন্তু তারা জাল-জালিয়াতি করছিল। গ্রেপ্তার হয় আরিফুল হক চৌধুরীসহ ঐ প্রতিষ্ঠানের আরও চারজন কর্মকর্তা ও কর্মচারী। তখন থেকে প্রশ্ন উঠতে শুরু করে, প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান সাবরিনা শারমিন হুসেইন ওরফে ডা. সাবরিনা আরিফ চৌধুরী ধরাছোঁয়ার বাইরে কেন?

আর ঠিক সেই সময়ে সাবরিনা শারমিন হুসেইন ওরফে ডা. সাবরিনা আরিফ চৌধুরী পত্রিকায় বিজ্ঞাপন এর মাধ্যমে এবং সামাজিক যোগাযোগ এর মাধ্যমে জানান, তিনি সরকারি কাজের অবসরে ঐ প্রতিষ্ঠানটিতে স্বেচ্ছাশ্রম দিয়েছেন।

তার এই কথার ফলে স্বাভাবিক ভাবে প্রশ্ন ওঠে, আসলে কার এই জালিয়াতির দায়?

ডিএমপির উপকমিশনার হারুন অর রশিদ জানিয়েছেন, করোনাভাইরাস পরীক্ষার নামে জালিয়াতির অভিযোগে এর আগে জেকেজি (জোবেদা খাতুন হেলথ কেয়ার) এর যেসব সদস্য গ্রেপ্তার হয়েছে, তাঁরা জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে যে, সাবরিনা শারমিন হুসেইন ওরফে ডা. সাবরিনা আরিফ চৌধুরী ই এই প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান। তাই প্রতিষ্ঠানের জাল জালিয়াতির দায় তিনি এড়াতে পারে না।

একই ভাষ্য দিয়েছেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এক বিজ্ঞপ্তিতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানায়, জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের চিকিৎসক সাবরিনা শারমিন হুসেইন ওরফে ডা. সাবরিনা আরিফ চৌধুরী কে সাময়িক ভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে। সরকারি চাকরি করেও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কর্মরত থাকার ফলে এবং অর্থ আত্মসাতের মতো শাস্তিযোগ্য অপরাধে অভিযুক্ত হওয়া্র ফলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সাবরিনা শারমিন হুসেইন ওরফে ডা. সাবরিনা আরিফ চৌধুরী সাময়িক বরখাস্তের সিদ্ধান্ত নেয়।

জেকেজি (জোবেদা খাতুন হেলথ কেয়ার) হেলথ কেয়ারের চেয়ারম্যান চিকিৎসক সাবরিনা শারমিন হুসেইন ওরফে ডা. সাবরিনা আরিফ চৌধুরী এর ব্যাংক হিসাব জব্দ করেছেন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সেল (সিআইসি)। ব্যাংক হিসাব জব্দ করার তালিকায় দেখা যায়, সাবরিনা শারমিন হুসেইন ওরফে ডা. সাবরিনা আরিফ চৌধুরী সাথে তার স্বামী জেকেজি (জোবেদা খাতুন হেলথ কেয়ার) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আরিফুল হক চৌধুরীও তার সাথে আছেন।

এই ঘটনার তদন্তের সঙ্গে যুক্ত পুলিশ কর্মকর্তা মাহমুদ খান বলেন, ‘ওভাল গ্রুপের সিইও আরিফুল চৌধুরী কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তিনি জানান, করোনা এর নমুনা পরীক্ষার জালিয়াতির সাথে আমাদের অফিসের কিছু কিছু লোক জড়িত ছিল। এই বিষয়টি আমি যখন জানতে পারি, তখন তাদের টার্মিনেট করেছি আমি। কাকে কাকে টার্মিনেট করেছিলেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার ওয়াইফ (সাবরিনা শারমিন হুসেইন ওরফে ডা. সাবরিনা আরিফ চৌধুরী), যিনি চেয়ারম্যান ছিলেন, আমি তাঁকে টার্মিনেট করেছি। আমি তখন বললাম, আপনি যদি ঐ প্রতিষ্ঠানের সিইও হন, তাহলে কীভাবে আপনার ওয়াইফ সাবরিনা শারমিন হুসেইন ওরফে ডা. সাবরিনা আরিফ চৌধুরী কে টার্মিনেট করবেন। সিইও কখনো প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যানকে টার্মিনেট করতে পারে না।’

তবে পুলিশ গ্রেপ্তারের আগ মুহূর্ত পর্যন্ত জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বা মন্ত্রণালয় এর অন্য কেউই সাবরিনা শারমিন হুসেইন ওরফে ডা. সাবরিনা আরিফ চৌধুরী এর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ করেনি। বরং প্রভাব খাটানোর চেষ্টা করেছে।

ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ল্যাবরেটরি মেডিসিন অ্যান্ড রেফারেল সেন্টারের একটি সূত্র থেকে জানা যায়, জেকেজি (জোবেদা খাতুন হেলথ কেয়ার) কতগুলো নমুনা সংগ্রহ করতে পারবে, তা বেঁধে দেয়নি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এর কারণে প্রতিদিন অনেক নমুনা পরীক্ষার জন্য তারা পাঠিয়েছিল। ৭৮১টি নমুনা একদিন পাঠায়। প্রভাবশালীদের আশীর্বাদ থাকায় তারা হাঙ্গামাও করত যে, কেন দ্রুত প্রতিবেদন তৈরি হচ্ছে না এসব নিয়ে। এই বিষয়ে অধিদপ্তর কে জানানো হয়েছিল।

এ প্রতিষ্ঠান এর অধ্যাপক শামসুজ্জামান চৌধুরী জানান, সাবরিনা শারমিন হুসেইন ওরফে ডা. সাবরিনা আরিফ চৌধুরী জুন মাসের প্রথম সপ্তাহের দিকে তাঁকে হোয়াটস অ্যাপে একটি বার্তা পাঠায়। ঐ বার্তায় বলেন, তিনি আর জেকেজি (জোবেদা খাতুন হেলথ কেয়ার) এর সাথে নেই। এ প্রতিষ্ঠানের কোনো কিছুরই দায়দায়িত্ব তিনি আর নিবেন না। কিন্তু অধিদপ্তর থেকে নির্দেশ না আসা পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটির নমুনা পরীক্ষা করে দিয়েছিলেন তিনি।

ওভাল গ্রুপের সাথে যুক্ত নাম না প্রকাশ করার শর্তে একজন ব্যক্তি বলেন, আরিফুল বলেন করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের পর, তিনি বিএমডব্লিউ গাড়ি ক্রয় করার জন্য টাকা জমিয়েছিলেন। আর সে ঐ টাকাটা মহামারিতে খরচ করতে চান। অনেকেই তাঁর এ কথা শুনে তার দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন। ৪৪টি বুথ থেকে সাবরিনা শারমিন হুসেইন ওরফে ডা. সাবরিনা আরিফ চৌধুরী এর চেষ্টায় নমুনা সংগ্রহের কাজ শুরু হইয়েছিল। আরিফুল একদিন হঠাৎ করেই এর মধ্যে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে গিয়ে সাবরিনা শারমিন হুসেইন ওরফে ডা. সাবরিনা আরিফ চৌধুরী কে মারধর করে। এ্রর ফলে ক্ষিপ্ত হয়ে সাবরিনা শারমিন হুসেইন ওরফে ডা. সাবরিনা আরিফ চৌধুরী গত ৮ জুন স্বামীর নামে শেরে বাংলা নগর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন। তারপর বিবাহ বিচ্ছেদ করার প্রক্রিয়া শুরু করেন। তিনি তার বন্ধুবান্ধবকে জানান, তিনি আর জেকেজি (জোবেদা খাতুন হেলথ কেয়ার) এর সঙ্গে নেই।

গত ২৩ জুন করোনা এর নমুনা সংগ্রহ ও ভুয়া রিপোর্ট দেওয়ার অভিযোগে জেকেজি (জোবেদা খাতুন হেলথ কেয়ার) হেলথ কেয়ারের কর্মচারী হুমায়ুন কবির ও তাঁর স্ত্রী তানজিনা পাটোয়ারিকে তেজগাঁও থানা-পুলিশ গ্রেপ্তার করে। পরের দিন ২৪ জুন হুমায়ুন কবীর ও তানজিনা ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবান বন্দি দেন ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে। এই জবানবন্দিতে হুমায়ুন কবীর জেকেজি (জোবেদা খাতুন হেলথ কেয়ার) হেলথ কেয়ারে চাকরি করার সময়, কীভাবে করোনার নমুনা সংগ্রহ এবং ভুয়া রিপোর্ট তৈরি করেছেন, সেই ব্যাপারে বিস্তারিত তুলে ধরেন। হুমায়ুন কবির বলেন, আরিফুল চৌধুরী এর নির্দেশেই তিনি জেকেজি (জোবেদা খাতুন হেলথ কেয়ার) হেলথ কেয়ারের অফিসে বসে করোনার ভুয়া রিপোর্ট বানাতেন।

তেজগাঁও থানা এর পরিদর্শক (তদন্ত) মোহাম্মদ কামাল উদ্দিন বলেন, ‘জেকেজি (জোবেদা খাতুন হেলথ কেয়ার) এর অফিস থেকে জব্দ করা করোনার নমুনা পরীক্ষার ফলাফল যে সত্যিই ভুয়া, আমরা সেটি নিশ্চিত হয়েছি। ইনস্টিটিউট ফর ডেভেলপিং সায়েন্স অ্যান্ড হেলথ ইনিশিয়েটিভ (আইদেশি) ল্যাবটি আমাদের জানিয়েছে, এমন কোনো ফলাফল তাঁরা দেননি, জেকেজি (জোবেদা খাতুন হেলথ কেয়ার) যে নমুনার পরীক্ষার ফলাফল দিয়েছিল। জেকেজি জালিয়াতি করে ভুয়া পরীক্ষার ফলাফল দিয়েছে।’

শনিবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরও এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানায়, জেকেজি তাদের সঙ্গে প্রতারণা করেছে।

You might also like

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More